[প্রথম প্রকাশ ২রা মার্চ ২০১২ দৈনিক কালের কণ্ঠ]
২০১২ বার্লিনালে চলচ্চিত্র উৎসবের ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসের সম্পাদনা ল্যাবে যে ৯টি ছবি নির্বাচিত হয়েছিলো তার মধ্যে ছিল ‘শুনতে কি পাও!’। বার্লিন ঘুরে এসে অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন
গুণী ফিনিস নির্মাতা পিরিও ওনকাসালোকে (Pirjo Honkasalo/ The 3 Rooms of Melancholia/ 2004) একবার বলতে শুনেছিলাম, ‘আমি ইউরোপের শীতকে ভালোবাসি। কারণ, শীতের রাতে ছবিঘরের উষ্ণতা ছেড়ে বেরিয়ে, তাড়া করে নিশ্চুপ মানুষ মন যখন অন্ধকার রাস্তায় নামে, আমি জানি, ওরা তখন আমার ছবিটাকে মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে।’ কথাটা খুবই যৌক্তিক মনে হচ্ছিল এই বার্লিন শহরে এসে। দেশে যখন উড়োজাহাজে উঠলাম, তাপমাত্রা তখন ২৬। বার্লিনে যখন নামলাম, এখানে তখন বিয়োগান্তে! সদ্য কেনা জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট শীতাবরণ গায়ে দিয়ে উড়োবন্দর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যেই নেমেছি, অমনি দেখি, আমাকে চমকে দিয়ে চারদিক ঝেপে নেমেছে বৃষ্টি! প্রথমবার যখন ইউরোপে এসেছিলাম, মনে আছে, আমার সবচেয়ে প্রিয় বৃষ্টিকে কী রকম ভয় পেতে শুরু করেছিলাম।
দেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিশীল আড্ডার নির্বাসন যখন একরকম মেনেই নিয়েছিলাম, তখন দূরদেশের এই বরফের বার্লিন শহরে আড্ডাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। ৯৯টি দেশের ৩৫০ জন তরুণ নির্মাতা, যাঁরা ইতিমধ্যেই একাধিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সঙ্গে যুক্ত, যাঁরা ইতিমধ্যেই নিজস্ব একটা চলচ্চিত্রভাষা আবিষ্কারে সচেষ্ট, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সঙ্গে আড্ডাটা অন্য রকম জমে ওঠে। তরুণ লেখক, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, প্রযোজক, এমনকি পরিবেশক- সবাই স্বপ্নে বিভোর নতুন এক চলচ্চিত্রদিনের সূচনায়। আর বার্লিনালের সে কী আয়োজন, সে কী উত্তেজনা এদের ধারণে, সিনেমার শৈল্পিক উত্তরণে!
ধূসর বরফের লেকে শুভ্র হাঁসের দল পোকা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে দেখছি, আর আমি বাঙাল এদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর দীর্ঘশ্বাস চেপে হাসিমুখে আড্ডা দিচ্ছি। বিশ্বায়নের এই যুগে সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেখানে তাঁদের নিজ নিজ চলচ্চিত্রভাষাকে সিঞ্চিত করছেন অন্যের ছবি থেকে, বিনির্মাণ করছেন তাঁদের নিজ ভাষাকে, পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্ব চলচ্চিত্র দরবারে, বাজারে- আমরা সেখানে কোন কুহেলিকার জালে আটকে গেছি! আড্ডায় বেশি দূর এগোতে পারি না। ওরা জানতে চায়, আমি কিভাবে বলব, আমার দেশে প্রতি মাসে বন্ধ হচ্ছে একটি করে প্রযোজনা সংস্থা, প্রতিদিন বন্ধ হচ্ছে একটি করে সিনেমা হল। ১৯৭১ সালে যেখানে ছিল ১২০০ হল, সেখানে আজ ২০১২ সালে ৬০০ কিংবা তারও নিচে। বছর পাঁচেক আগেও যেখানে দাবি করতাম, বছরে আমরা ৮০-৯০টি ছবি মুক্তি দেই, সেখানে আজ ২৫-৩০-এ নেমে এসেছে; এবং প্রতিদিন কমছে। এতটুকু একটা ইন্ডাস্ট্রি, হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ, তবু কত দূরত্ব আমাদের! কেউ কারো পথ মাড়াই না। আমরা ভুলে গেছি, একদিন আমাদের সবার ধর্ম এক ছিল- চলচ্চিত্র।
আমি এসেছি আমার কাজে, দুঃখ করে সময় নষ্ট করাটা আমার জন্য বিলাসিতা। তাই আমি সবকিছু ভুলে আবার কাজে নেমে পড়ি। ছবি নিয়ে এসেছি সম্পাদনা ল্যাবে ‘শুনতে কি পাও!’। বার্লিনালে ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসের সম্পাদনা ল্যাবে যে ৯টি ছবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তার মধ্যে এসেছে আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘শুনতে কি পাও!’। ফিকশন ধারার বন্ধুরা বলছে, এটা প্র্যামাণ্য। আর প্র্যামাণ্য ধারার বন্ধুরা বলছে, এটা ফিকশন। আমি বলি, স্রেফ ছবি। বিশাল আকারের নিচে ছোট ছোট মানুষের অদম্য সাহস আর জীবনের প্রতি ভালোবাসার ছবি ‘শুনতে কি পাও!’। সারাদিন ল্যাবে কাজ করি, সেমিনারে বক্তাদের আলোচনা শুনে ঘুরে বেড়াই আর সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে চলে যাই সান্ধ্য নিমন্ত্রণে।
একদিন এমনি এক বিলেতি আড্ডায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় একজন ডেকে বললেন, ‘তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো!’ আমি অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি, বললেন, ‘উৎসবের পরিচালক আমার বন্ধু। ওর কাছে শুনলাম, এই প্রথম বাংলাদেশ থেকে কোনো ছবি এসেছে। তাই খুঁজছিলাম। আমি দাউদ হায়দার।’ ৩৬ বছর স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি-লেখক এই কৃতী অগ্রজের মুখ দেখলাম এক অন্য আলোয় উদ্ভাসিত। দেখলাম, অনুজের মুখের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম, এখন হতাশ হলে চলবে না। এখন যা করার, আমাদেরই করতে হবে।
[প্রথম প্রকাশ ২রা মার্চ ২০১২ দৈনিক কালের কণ্ঠ]