[সাক্ষাতকার/ প্রথম প্রকাশ ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩/ আলোকিত বাংলাদেশ]
কামার আহমাদ সাইমন ও সারা আফরীন/ ছবিঃ জাকির হোসেন
তৈমুর রেজা : একদম আরম্ভ থেকে শুরু করি। সিনেমা বানানোটা কোথায় শিখলেন?
কামার আহমেদ সাইমন : সাধন-ভজন দুইভাবে হয়। আপনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, আবার গুরুমুখী বিদ্যাও আরেক তরিকা। তার জন্য সাক্ষাত গুরুর দরকার নাই, ভাব গুরু হতে পারে।
সিনেমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুইভাবেই, তবে কয়েকটা মাইলস্টোন আমি শনাক্ত করতে পারি… প্রথম ঘটনাটা ঘটলো আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি।একদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে দেখি চাইনিজ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলছে। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বিনা পয়সায় ছবি দেখাচ্ছে। আমি বড় হইছি পুরান ঢাকার খুব রক্ষণশীল একটা ফ্যামিলিতে। সেইখানে বড় পর্দায় এত মজার মজার ছবি দেখা যায় সেটাই আমার জন্য একটা বিস্ময়।
তৈমুর : আপনার বাবা কি করতেন?
কামার : আমাদের বাড়ি ছিল উর্দু রোডে, বাবা ব্যবসায়ী। একান্নবর্তী পরিবারে কঠোর অনুশাসন মেনে চলতে হত। ওইরকম একটা পরিবারে থেকে সাতদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে একসাথে এতোগুলা চৈনিক ছবি দেখাটা অন্য অভিজ্ঞতা। পরের ঘটনাটা বুয়েটে থাকাকালীন, আমি আর সারা (সারা আফরীন, প্রযোজক, ‘শুনতে কি পাও!’) তখন আর্টিটেকচার পড়ছি একসাথে। এটা সম্ভবত ’৯৫/ ৯৬ সালের কথা। তখন ঢাকায় যত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়েছে তার সবগুলোতে আমরা অ্যাটেন্ড করেছি। এভাবে অচেনতভাবেই ‘ট্রেনিং’ হচ্ছিল সিনেমার। এই সময় একটা ছবি আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। আকিরা কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস‘। তখন বুয়েটে ‘ডিজারটেশন’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। কোন একটা বিষয়ের উপর প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। সহপাঠীরা বিল্ডিং নিয়ে, কনস্ট্রাকশন মেশিন বা টেকনলজি নিয়ে কাজ করছে, আমরা ঠিক করলাম… ‘ড্রিমস‘ সিনেমার ওপর প্রেজেন্টেশন দিবো।
১৯৯৮ সালে দুজনে গিয়ে ভর্তি হলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন-এর কোর্সে। তিন মাসের কোর্স, সপ্তাহে চারদিন, দুপুর চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। বুয়েটে পড়াশোনার অবিশ্বাস্য চাপ। সারাক্ষণই সাবমিশন চলছে, প্রজেক্ট চলছে, পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যেই আমরা পাগলের মতো ছবি দেখছি। এইভাবে গ্রাজুয়েলি সিনেমার নেশাটা চেপে বসছিল। যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি তখন সোজা চলে গেলাম এফডিসি, ইচ্ছা ছবি বানানো শিখবো। ওখানে গিয়ে তো মাথা খারাপ। এলাহি কারবার ঘুরে-ঘুরে দেখি। হঠাৎ আমাকে ধরে একটা বস্তা দিয়ে উপরে তুলে দেওয়া হলো। একজন গান গাইবেন, আমার কাজ হবে উপর থেকে পাতা ওড়ানো।
তৈমুর : এফডিসি কি একা একাই চলে গেছিলেন, না কারো রেফারেন্স ছিল?
কামার : একরকম একাই যাওয়া… এরপর এফডিসি দেখেতো আমি শকড। ব্যাপারটা এইরকম যে, আপনি একটা শিশুর মতো সরল মনে একটা জায়গায় গেলেন… সেখানে অবাক হয়ে আপনি সব কিছু দেখছেন, হঠাৎ কেউ আপনার গালে ঠাস করে চড় মেরে বসলো। আমার মনে হলো, এফডিসি আমার জন্য না। আমি তখন খুবই সেনসিটিভ। একটুতেই মন খারাপ হয়, কান্না পেয়ে যায়। মন খারাপ হলে দুতিনদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। আমি এত হতাশ হয়ে গেলাম যে মনে হলো, কিছু হবে না আমাকে দিয়ে। ছবি দেখা কিন্তু চলছে। বড় একটা গ্যাপের পর একদিন মাটির ময়না দেখে মাথা ঘুরে গেল। তখন তারেক মাসুদ কে, মাটির ময়না কি… আমি কিচ্ছু জানি না। বলাকাতে ছবি দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবতেছি, এতটা নিয়ে ‘রিস্ট্রেইনড’ ছবি বানানো বাংলাদেশের ডিরেক্টরের পক্ষে তো সম্ভব না! ডিরেক্টরকে খুঁজতে লেগে পড়লাম। তারেক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো, আলাপ হলো। সেই যে দেখা হলো, এরপর সম্পর্ক শুধু বেড়েছে, কমেনি। একটা সময়ের পর তার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতাম।
তৈমুর : আনুষ্ঠানিকভাবে ছবি বানানোর সঙ্গে যুক্ত হলেন কবে? তারেক মাসুদের সঙ্গেই কি শুরু হলো আপনার ফিল্ম ক্যারিয়ার?
কামার : সিনেমা বানানোর কথা স্থাপত্যের ছাত্র থাকতেই ভেবেছি। পাশ করার পর আমি আর সারা মিলে একটা স্টুডিও করলাম ‘বিগিনিং প্রোডাকশন’। ডিজাইন বা এই ধরনের এলোমেলো কাজ তো আগে থেকেই করছিলাম। আমাদের টার্গেট ছিল এসব করতে করতেই ছবি বানাবো একদিন। তারপর আমাদের অজান্তেই অর্গানাইজেশন বড় হতে লাগল। একসময় দেখি বিশ/পঁচিশজন লোকের স্যালারি দিতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হয়েছে এই সময়টাতে। তারপর বুঝলাম, এভাবে হবে না। আবার নতুন করে শুরু করতে হলো।
তৈমুর : প্রথম ছবি বানাতে গেলেন কবে?
কামার : শুরুর দিকে ‘দিন বদলের পালা’ (স্টোরিজ অব চেঞ্জ) নামে একটা ডকুমেন্টরি করেছিলাম। কিন্তু বড় প্রোডাকশনে কাজ করেছিল প্রথম তারেক ভাইয়ের সঙ্গেই। আমি আর্টিটেকচারে পড়েছি। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছি অন্তত ছয়-সাত বছর। এসব দেখেই হয়ত তারেক ভাই একদিন জিজ্ঞেস করলেন, কাগজের ফুল ছবির প্রধান সহকারী হবো কিনা? আমি তো হতভম্ব! এক বারে চিফ এডি! সঙ্গে সঙ্গে এসএমএস দিলাম সারাকে। সারা বললো, নিয়ে নাও অফারটা, দরকার হলে আমি চাকরি করব। আমাদের খুব উত্তেজনা। বিপ্লবী একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। তো, দুই বছর দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা তারেক ভাইয়ের সঙ্গে জলে-জঙ্গলে, ঢাকাতে, কলকাতায় ঘুম-টুম ফেলে কাজ করেছি শুধু। প্রি-প্রোডাকশন কাজ চলছে, এরমধ্যেই টিমে প াশের বেশি লোক হয়ে গেল। কস্টিউম, সেট, কাস্টিং। কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট, ঢাকায় আলাদা অফিসÑ সব মিলে তুঘলকি কা- আরকি। এরপর তারেক ভাই হুট করেই ডিসিশন নিলেন কাগজের ফুল প্রোজেক্ট বন্ধ করে দেবেন। অন্য কাজ করবেন।
তৈমুর : রানওয়ের কাজ কি তখন শুরু হয়েছিল? না আরো পরে?
কামার : না, রানওয়ের কাজ আরো পরে হয়েছে। তখন শুরু হলো নরসুন্দরের কাজ। বড় একটা টিম দাঁড়িয়েছে। এদের ট্রেইন আপ করে তৈরি করা হয়েছে। একটা এক্সপার্ট ক্রিয়েটিভ টিম আছে। এর মধ্যে হঠাৎ পোস্টপোন্্ড হলো কাগজের ফুল। তারেক ভাই বললেন, নেক্সট কাজ তিন মাসের মধ্যে শুরু হবে। এখন একটা ট্রেইন আপ প্রজেক্ট করে ফেলি। নরসুন্দর এই সময়কার কাজ। আমি অবশ্য ঠিক করেছি, কাজ যদি করি তো কাগজের ফুলেই করবো।
তৈমুর : শুনতে কি পাও ছবির প্রসঙ্গে আসি। এই ছবিটার কথা ভাবলেন কখন?
কামার : এখানে কিছুটা কাকতাল আছে। কাগজের ফুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর কোনো কাজে ঢুকিনি। এই সময়ে আইলার ঘটনা ঘটলো। ২০০৯ সালের মে-জুন মাসের দিকে পত্রিাকে প্রচুর ছবি ছাপা হত আইলার। একদ পেইন্টিং-এর মতো সব ছবি। ঠিক সুলতানের ছবি। ছবিগুলো দেখতে দেখতেই একটা আইডিয়া আসলো মাথায়।
তৈমুর : ডকুমেন্টারির দিকে আপনার কিন্তু কখনোই তেমন ঝোঁক ছিল না। অথচ প্রথম বড় কাজ করতে গেলেন ডকুমেন্টরিতে। এর কারণটা কী?
কামার : আমি কিন্তু ছবিটাকে ডকুমেন্টার বা ফিকশন এভাবে ভাবিনি। আমার ভাবনা ছিল ছবি বানাবো একটা। ডকুমেন্টারি বা ফিকশন হিসেবে না একটা ছবিকে আমি ছবি হিসেবেই বুঝতে চাই। আপনি হয়ত টেকনিক্যালি প্রশ্নটা করলেন যে আমি জাঁর হিসেবে কেন ডকুমেন্টারি নিলাম। আমার সবসময় যেটা মনে হয় সেটা হলো, জীবন কল্পকাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যখন আপনিÑ কবিতা হোক, চিত্রকলা হোক বা চলচ্চিত্র হোকÑ জীবনকে আপনার শিল্পে ধারন করতে পারবেন তার চেয়ে পাওয়ারফুল আর্ট আর কিছুতেই হতে পারে না। আমি ডকুমেন্টারি বানাতে চাইনি। জীবনকে ধরতে গিয়ে আমি জাঁর হিসেবে ডকুমেন্টরিটাকে নিয়েছি।
তৈমুর : তারেক মাসুদও এইভাবে বিষয়টারে দেখতেন বোধহয়। উনি যে-কথাটা বলতে ভারি পছন্দ করতেন, ‘মাটির ময়না ইজ মোর অব আ ডকুমেন্টারি’ বা ‘মুক্তির গান ইজ মোর অব আ ফিকশন’…
কামার : হুম। কারণ মুক্তির গান তো সম্পাদনার টেবিলে বানানো ছবি।
তৈমুর : ডকুমেন্টরি নিয়ে আপনার ভাবনার সঙ্গে তারেক মাসুদের কথার মিল আছে।
কামার : মিল তো থাকতেই হবে। কারণ আমার সিনেমার যে ট্রেনিং সেটা কমপ্লিটলি ইন ডেব্্ট টু তারেক মাসুদ। চোখ খুলে দেওয়ার একটা বিষয় তো আছে। এইসব নিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। তার কথার মধ্যে আমি আমার নিজের সিনেমা খুঁজে পেয়েছি।
তৈমুর : আপনার ছবির কথায় ফেরত আসি। শুনতে কি পাও ছবির আইডিয়া পাওয়ার পর কাজে নামলেন কীভাবে? শুরুর গল্পটা বলেন।
কামার : ওই পত্রিকার ছবি থেকেই শুরু। তেমন কোনো প্ল্যান ছিল না। সারাকে বললাম, এখানে একটা ছবি আছে। আসো আমরা মুভিটা করি। লেটস মেক সাম বাজেট, ছোট্ট একটা রিসার্চের টাকা জড়ো করে ঘোরাঘুরি শুরু করে ফেলি। তখন অফিস বন্ধ করে দিছি। টাকা আসার কোনো রাস্তা নাই। ও চাকরি করে জাস্ট কোন রকমে ঠেকা দিয়ে রাখছে। খুব বাজে অবস্থা। এইরকম একটা বেসামাল অবস্থায় প্ল্যান ছাড়াই আমরা ভোলা থেকে যাত্রা শুরু করলাম। পুরো তিনমাস ঘোরাঘুরি চলল, অন অ্যান্ড অফ। ভোলা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি, বরগুনাÑ প্রত্যেকটা জায়গাতে আমরা গেছি। আমি একটা ফিকশনের মতো ভাবতেছিলাম বিষয়টারে। রিসার্চের সময়ে একটা স্টোরি ডেভেলপ করতেছিলাম। ক্যারেক্টার ঠিক করে নিতেছিলাম। কোন ক্যারেক্টারে জন্য কাকে কাস্ট করা যায় সেই একজাক্ট মানুষটারে খুঁজতেছিলাম। একদম ফিকশনের বেলায় যেমনে ভাবা হয়।
খেয়া মেজবা : ছবির কাস্টিং খুবই দুর্দান্ত লাগছে আপনার। বিশেষ করে প্রধান যে নারী চরিত্র…
কামার : হ্যাঁ, এই কাস্টিংটা আমার খুবই যুতসই লাগছে। ছবিতে আমি তাকে প্রেজেন্ট করেছি উইথ কমপ্লিট ডিগনিটি। তাকে শ্রদ্ধা করে, একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে দেখা হয়েছে। শি ইজ মাই হিরোইন ইন দিস মুভি। তো, আপনি এখানে জাঁর হিসেবে হয়ত ডকুমেন্টারি দেখছেন। কিন্তু অ্যাজ দ্য ফিল্মমেকার, আমার মধ্যে প্রচ- ক্ষুধা ছিল জীবনের ভেতর থেকে গল্প বের করে আনার। এটা এই ছবিতে এই জন্য ঘটেনি যে, আমি ডকুমেন্টারি জাঁরে বানিয়েছি। আমি যদি ফিকশন বানাই সেখানেও আপনি ডকুমেন্টারির গন্ধ পাবেন।
তৈমুর : সারা দি’কে একটু জিজ্ঞেস করি। আপনার এক্সপার্টাইজ কোন দিকে?
সারা আফরীন : আমি টোটালি প্রডিউসার।
তৈমুর : ছবির শ্যুটিং-এর সময় আপনি কি পুরোপুরি লোকেশনে ছিলেন?
সারা : একদম পুরোটা সময় ধরে থাকি না। মাঝেমধ্যে থেকেছি। ওই সময়ে ছবির বাইরেও আমার একটা চাকরি ছিল।
কামার : ও যখন ঢাকাতে ছিল তখনও কিন্তু আমার কাছে কোনো ফোন আসত না। সব কিছু মূলত ও সামলেছে।
তৈমুর : ছবির গবেষণার জায়গাটাতে আসি। ছবির বুনোট বেশ কমপ্লেক্স। কনটেক্সটটা হচ্ছে, সুন্দরবনের কাছাকাছি একটা গ্রাম সুতারখালি। আইলাতে এই গ্রাম ডুবে গেছে। গ্রামের লোক এসে আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার ওপর। এইখানে আমরা একটা পরিবারের গল্প দেখছি। আবার এই পরিবারটাকে ঘিরে একটা কমিউনিটির গল্পও পাচ্ছি আমরা। ডকুমেন্টারির পরিসরে এরকম একটা পরিকল্পনা গড়ে তোলা নিশ্চয়ই খুব জটিল কাজ। সবকিছু ডিরেক্টরের প্রিডেকশনে থাকতে হবে, নইলে প্ল্যান ওয়ার্ক করবে না। এরকম একটি গল্প ক্যামেরায় নিয়ে আসা কী করে সম্ভব হলো?
কামার : আমি একটু কমপ্লেক্স উত্তর দেব। ছবিতে বৃষ্টি থামার পরে একটা লং শট আছে। বিশাল আকাশেল নিচে ছোট ছোট অনেক মানুষ। রিসার্চের কাজে আমি যখন এই লোকেশনগুলোতে ট্যুর করতাম সবসময় এই রকম দৃশ্য আমি দেখতাম। একটা বিরাট আকাশ, নিচে ছোট ছোট লোক। কিন্তু এই মানুষগুলোর কালেক্টিভ পাওয়ার একটা এবসলিউটলি ইম্পসিবল ব্যাপার, একটা নদীর প্রবাহ থামিয়ে দিতে পারে। প্রায় ঐশ্বরিক শক্তি। সুলতানের ছবিতে এই জিনিসটাই আছে। প্যারিসে যখন এই প্রশ্নটা আমাকে করা হলো, আমি তখন বলেছিলাম, আমাদের দেশে এই ক্যানভাসটা আছে। বিশাল আকাশ, আর গুটি গুটি মানুষ। এই গল্পটা আমাকে বলতে হবে। রিসার্চের সময় এই গল্পগুলো ঘুরছিল আমার মাথায়। এই মানুষগুলো তো আসলে ক্ষুদ্র না। তারা বিশাল, তারা অনেক পাওয়ারফুল। সুলতান তার ছবিতে এইটা আঁকছেন। বাংলার মানুষ আসলে পেশীবহুল। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। এটা হচ্ছে আমার স্টার্টিং পয়েন্ট। এখান থেকে আমি ন্যারেটিভ খুঁজতে শুরু করি। ওই যে ছোট ছোট মানুষ, এদের মধ্যে একজনকে দিয়ে শুরু হবে আমার গল্প। থার্ড লেবেলে গিয়ে আমি লোকেশন এবং ক্যারেক্টার সিলেকশন শুরু করি। একটার পর একটা জায়গায় যাচ্ছি। সুতারখালি বাঁধে এসে দেখলাম অনেক মহিলা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু একটা মেয়ে, দেখতে পাচ্ছি, মাথায় কাপড় নাই, আর সবার চেয়ে ইি চারেক লম্বা। তার সাথে দেখি লেঙ্গুর একটা। আমি লোকেশন স্কাউটিং-এর জন্য এই জোনে যে লোকটাকে তিন-চারমাস ধরে কাজে লাগাচ্ছি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই যে খালি মাথায় দাঁড়ানো মেয়েটা, ও কে? লোকটা বলে, ‘আমার বউ’। তখন আমি ভালভাবে তাকিয়ে লোকটাকে দেখলাম। ওই মেয়েটার চেয়ে বয়স রীতিমতো কম লাগে এর। তখন চলে যাই, কিন্তু ফেরার পথে আমি ওই গ্রামে আবার থামি। মেয়েটাকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলি। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তার ছবি দেখি। একদম কাস্টিং যেভাবে হয় অবিকল সেইভাবে। তো, মেয়েটাকে আমার পছন্দ হলো। এরপর আমি ওর স্বামীকে খেয়াল করলাম। ক্লিন শেভড। প্যান্ট-শার্ট পরা। আমি বললাম, ঘরে গিয়ে একটা টুপি পরে আসো। সে লাল রঙের একটা ক্যাপ পরে আসলো। আমি ইমাজিন করলাম, গালটা একটু ভাঙা, দাড়ি লাগবে। কাস্টিং-এর সময় আপনি যা করেন আরকি।
তৈমুর : আপনার এসব চরিত্র ছবিতে দারুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছে। খুব ব্যক্তিগত ঘটনাগুলোও ছবিতে আশ্চর্য সহজ-সাবলীলভাবে এসেছে। ছবির এই দিকটা, আমার ধারণা, যে কোনো দর্শকের কাছে সারপ্রাইজিং লাগবে। বাংলাদেশের একজন ডিরেক্টর এই স্ট্যান্ডার্ড-এর ধারণা পাইলেন কোথায় সেটা একটা রহস্য। ছবির সিকোয়েন্সগুলো যেন একদম রিয়ালিটি থেকে ইমিডিয়েটলি পর্দায় এসে পড়ছে। এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হলো বলেন তো?
কামার : আমি ছবিটার জন্য টানা বিশ মাস ধরে কাজ করেছি। অন অ্যান্ড অফ। ছবির জন্য আমার টোটাল ফুটেজ দাঁড়াইছিল ১৭০ ঘণ্টা। আমি দিনের পর দিন ওদের ভেতর থেকেছি। আস্তে আস্তে ওদের একজন হয়ে গেছি। যখন আমি ওদের একজন তখনই কেবল ওরা আমাকে ওদের লাইফের মধ্যে ঢুকতে দিছে। ছবির একদম প্রথম দৃশ্যটা দেখেন। মশারির মধ্যে মা-ছেলের খুবই নিজস্ব খুনসুটি। অনেকদিন আমি এই সিকোয়েন্সটা টার্গেট করেছি। কিন্তু করতে পারিনি। একদিন মেয়েটাকে আমি বললাম, তোমার এখানে আমি কাল থাকব। সে বললো, হ্যাঁ, ভাইয়া, আপনি এসে বলবেন। আমি বললাম, না, এসে বলব না। আমি তোমার ঘরে ঘুমাব। ও বলে, ঠিক আছে ভাইয়া, থাকেন। কোনো অসুবিধা নাই। ওর ঘরটা ছিল আসলে টানা ঘর। মাঝখানে সেমি পার্টিশন। আমি ওই পার্টিশনে একটা চৌকিতে দুইদিন ঘুমালাম। দেখলাম, হচ্ছে না। একটুতেই ও কনশাস হয়ে যায়। প্রথম দুই দিন আমি ক্যামেরা একদম খুলি নাই। পরে, আমি ক্যামেরা নিয়ে ঘুমাইছি। ইউনিটকে বলে দিছি, সকালে দুই ঘণ্টা কেউ আসবা না। নক করবা না। তৃতীয় দিন যখন এই সিকোয়েন্সের শুটিং করি ও তখন আলতু-ফালতু গান গাচ্ছিল। আমি বললাম, এসব তুমি কি গাচ্ছো? একটু ভাল গান গাও। রোলিং-এর মধ্যেই বললাম। ফট করে সে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গাওয়া শুরু করলো। এরে আপনি কীভাবে ডকুমেন্টারির ছাঁচে ফেলবেন? এই ছবির লাইটের জায়গাটা দেখেন। এই সিকোয়েন্সের লাইট সলভ হইল কেমনে? ঘর তো অন্ধকার। প্রথম দুই দিন আমি খেয়াল করছি যখনই লাইট নিয়ে কাছে যাই খুব কনশাস হয়ে যায় ছেলেটা। আমার আর ওর মার ভেতরে রাখতে হবে ওকে। তো, এই সিকোয়েন্স-এর লাইট আসলো কোত্থেকে?
খেয়া : লাইট সোর্স ওর হাতে দিয়ে দিতে হবে।
কামার : রাইট। আমি ওর হাতে লাইটটা ধরায়ে দিছি। এবার যখন সে লাইট নিয়ে খেলতেছে তখন আপনি কিন্তু একটা আলো-ছায়ার খেলা পাচ্ছেন। আমার ছবির প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের পেছনে এই ধরনের গল্প আছে। আমি শ্যুটিং-এর সময় যে পদ্ধতিতে কাজ করতেছিলাম সেইটারে ফিল্ম থিওরিতে বলে ‘ফ্লাই অন দ্য ওয়াল’। আমাদের এই কথাবার্তা একটা মাছি যদি দেয়ালে বসে রেকর্ড করে সেটা কিন্তু আমাদের বোঝার উপায় নাই। আমরা স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা চালায়ে যাব। এটা ডকুমেন্টারি বানানোর সিনেমা ভেরিতের স্টাইলে খুব চালু। সত্তরের দশে ফ্রান্স-এ যে মুভমেন্ট হইছে এই স্টাইলটা ছিল তারই ফসল। আমার ইনটেনশনাল চয়েস ছিল মুভিতে এইটা আমি করব।
তৈমুর : আপনার ছবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্সের ক্রিটিক হাজির করে। সেটা করে সুতারখালী গ্রামবাসীর ডায়লগের মধ্য দিয়েই। এইটা খুব একসাইটিং লাগছে আমার। যেমন ‘হতদরিদ্র’ শব্দটার যে প্রচলিত ডেফিনেশন সেটা এই গ্রামের কনটেক্সট-এ অচল হয়ে গেছে। ছবিতে চায়ের দোকানদারের কথা থেকেই সেটা বুঝে ফেলি আমরা।
খেয়া : গ্রামের মেয়েদের একত্রে বসে আড্ডার যে সিকোয়েন্সটা সেইটার কথাও বলা যায় এখানে। তখন একজন মহিলার ডায়লগ ছিল…
কামার : খুব ভয়ানক ডায়লগ আছে ওইখানে। আপনারা খেয়াল করছেন কিনা জানি না। মহিলাটা জিজ্ঞেস করতেছিল, প্রেমডা তাইলে হইল কুতায়? এই খানে ‘প্রেম’ মানে ‘ফিজিক্যাল লাভ-মেকিং’। এটা সে হাসতে হাসতে বলছে, আবার তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমাদের মধ্যবিত্তের যেসব সংস্কার তার একদম বাইরে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছে। সেটা একটা ভিন্ন পরিসর। এইখানে গ্রামের চারজন মহিলা যখন কথা বলছে, তাদের একজন বলতেছে, এই তোর বড় পাছা সরা। আপনি পারবেন এটা বলতে? কখনোই পারবেন না। অন্য দিকটা খেয়াল করেন, চায়ের দোকানে একজন মহিলা ছাড়া আর কাউকে কি দেখছেন আপনি? একটা বুড়ি ছাড়া? সোশাল কনট্রোলটা বুঝতে পারছেন? প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সনাতন ‘সমাজ’ বলে যে জিনিসটা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে দেখা যায় অবিকল সেই জিনিস।
তৈমুর : কিন্তু যখন বাঁধ নির্মাণের কাজ হয় তখন কিন্তু দেখি নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজ করছে। উৎপাদন ব্যবস্থাতে যদি ভূমিকা থাকে তাহলে সোশাল কনট্রোলটাও তো থাকার কথা কিছুটা।
কামার : ওইটা উৎপাদন ব্যবস্থা না। ডিজাসটার ম্যানেজমেন্ট। সাধারণ পরিস্থিতিতে মেয়েরা শুধু গেরস্থালি করে এখানে। ফরম্যাল ইকনমিক্সের মধ্যে তারা আসলে অনুপস্থিত।
তৈমুর : একটা নৈতিক প্রশ্ন তুলতে চাচ্ছি। এই ছবিতে আমরা সৌমেনের পরিবারের খুব প্রাইভেট পরিসর দেখি। আমাদের হিউম্যান ডিগনিটির যে ধারণা তার সঙ্গে প্রাইভেসির সম্পর্ক আছে। প্রাইভেট পরিসরকে পাবলিক হতে না দেওয়াটা হিউম্যান ডিগনিটির অংশ। এই ছবি কিন্তু এক জনের শোবার ঘরে ঢুকে সবার সামনে সেটাকে এক্সপোজ করে। ছবির ডিরেক্টর হিসেবে এই বিষয়টারে আপনি কীভাবে দেখেন?
কামার : আমি কিন্তু ওদের মধ্যে বরাবর একটা প্রতিযোগিতা দেখেছি। ওদের প্রায় সবার মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল ক্যামেরার মধ্যে নিজেকে দেখানোর। আমি কিন্তু বলব, এই নৈতিক জায়গাটাতে আমি খুব সাকসেসফুল। এই মেয়েটার গল্পের মধ্যে আমি ঢুকতে পেরেছি। ছবিতে যেভাবে সে হাজির হয়েছে তার সবগুলো ক্ষেত্রেই সে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ছবিতে এভাবে সে দেখা দিতে চায়। আমি কেবল তখনই রোলিং করেছি যখন আমি মোর দ্যান কনফার্ম যে সেই এই দৃশ্যটা চায়। আমার চরিত্রদের সঙ্গে আমার একটা দারুণ মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে, যেখানে আমি তাদের ক্যারেক্টারগুলো বুঝতে পারছি, তাদের অ্যাটিটিউডের মানে বুঝতে পারছি। ছবিতে ইচ অ্যান্ড এভরি ক্যারেক্টার প্রেজেন্ট করা হইছে উইথ ডিগনিটি।
তৈমুর : আপনার ছবির একটা বড় সাফল্য হলো, ক্যামেরা মোটেই দর্শককে ভিজুয়াল প্লেজার দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ক্যারেক্টার-এর ডিগনিটি সবসময় মাথায় রাখা হয়েছে।
কামার : একজ্যাক্টলি। সি নেভার লস্ট হার ডিগনিটি।
তৈমুর : আপনাকে ধন্যবাদ।
[আলোকিত বাংলাদেশের জন্য সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন তৈমুর রেজা। খেয়া মেজবা]