- ছবির হাট, ইডফা ফোরাম/ ছবিঃ http://www.compagnietheater.nl
৮০ সেকেন্ড বাঁচাতে অস্বাভাবিক গতি বৃদ্ধি এবং ১০৭ জন যাত্রির মৃত্যু, জাপানের ইতিহাসের ভয়াবহতম নাগরিক- ট্রেন (কম্যুটার ট্রেন) দূর্ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো ৮০ সেকেন্ডের বিলম্বে কি এমন হতো? কিসের ভয়ে ৮০ সেকেনন্ডকে বাঁচাতে গিয়ে এতোগুলো প্রাণের বলি? হঠকারিতা কি শুধু
ড্রাইভারের? নাকি উৎকর্ষের সন্ধানে আচ্ছন্ন জাপানী জাতি, যারা সামান্যতম বিলম্বকেও গ্রহণ করতে শেখেনি, সেই অসহিষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা? প্রচণ্ড শীতের সকালে বিশাল হলঘরের পিনপতন নিরবতায় ঘুঘু সব ছবির খরিদ্দার। মঞ্চের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে শেষ প্রশ্নটি ছুড়ে দিলেন মৃদুভাষী, গুণী জাপানী নির্মাতা কিয়োকো মিয়াকি। সাত বছর আগের এই ট্রেন র্দূঘটনাকে নিয়ে তার পরবর্তী অনুসন্ধানী প্রামাণ্যছবির ভাবনাপত্র উপস্থাপন করছেন মিয়াকি, পাশে উপবিষ্ট তার অস্কার মনোনীত প্রযোজক মাইক লারনার আর প্রখ্যাত পরিবেশক বিবিসির নিক ফ্রেজার। তিনজনের দল একদিকে, আর বাকি তিনদিকে তিরিশজন পরিবেশক – উত্তর আমেরিকা থেকে এইচবিও, সানড্যান্স, হটডকস, ইউরোপের সব বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেল, কোরিয়ার কেবিএস, জাপানের এনএইচকে – কে নেই এখানে? এদের চারপাশে থিয়েটার মঞ্চের আদলে উপবিষ্ট শ’তিনেক পরিদর্শক। মাথার উপরে চার-চারটে প্রক্ষেপন পর্দায় প্রদর্শীত হচ্ছে ছবির ‘ট্রেইলার/ টিজার’।
গেলো বিশ বছর ধরেই বিশ্বের বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসব আমস্টারডামের ইডফা আয়োজন করে আসছে এই বিশেষ আসর। সোজা কথায় ছবির হাট, তোমার আছে চিত্রনাট্য, ছবি বানানোর সক্ষমতা – আর আমার আছে ইচ্ছা এবং টাকা, আসো আমরা ছবি বানাই। এ এক মজার মেলা, লগ্নিকারীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন ভালো চিত্রনাট্যের পেছনে, আর নির্মাতারা ছুটে বেড়াচ্ছেন অভিজ্ঞ প্রযোজক/ পরিবেশকের খোঁজে। পরিদর্শক এর চেয়ারে বসে দেশের তরুণ প্রজন্মের সফলতম বাণিজ্যিক নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম ভাইয়ের কথা মনে পরে গেলো। শুনেছিলাম, ‘মনপুরা’ ছবির ক্যান নিয়ে নাকি সেলিম ভাই বিজয় নগরের ছবির হাটে দিনের পর দিন বসে থাকতেন (আমি কেতাবী হাট না, ঢাকার প্রাচীন এবং আসল ছবির হাটের কথা বলছি)। কথাটা শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই সাথে সেলিম ভাইয়ের সাহসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিলো কয়েকগুণ। আজ এই ছবির হাটে বসে মনে হচ্ছিলো, মধ্যবিত্তের ‘মানবোধের’ বেড়াজালে আটকে থেকে ছবির দিনবদল করা যাবে না। আর এর জন্য চাই সেলিম ভাইয়ের মতো সাহসী, এমনকি রেদোওয়ান রনির মতো দুঃসাহসী পরিচালকের, যিনি তার ‘চোরাবালী’ ছবির নায়কের অভাবে শুধু নায়ক আমদানীই করেননি – ‘আইটেম-ড্যান্স’সহ পুরোদস্তুর ‘পয়সা-উসুল-ছবি’ করার মতো প্রতিভা দেখিয়েছেন। সেইসাথে অনন্ত জলিলকেও সাধুবাদ জানাই তিনি শুধু শাকিব খানের একচ্ছত্র দাপটকেই চ্যলেঞ্জ করেননি, সেইসাথে বাণিজ্যিক ছবির কারিগরী মানের প্রচলিত ধারণাকেও বদলে দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা শুধু বোধোদয়ের, দেশের প্রদর্শক-পরিবেশক-লগ্নিকারীদের। এইরকম কিছু হাট পরিদর্শন এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
আশার কথা হলো ইমপ্রেস ছাড়াও এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যেগী হয়েছেন। কিন্তু আশঙ্কা থাকে যে তারাও যদি একটা ছবির পর্যায়ক্রমিক সম্ভাবনা উপলব্ধি না করে ঈদ উপলক্ষ্যে বিজ্ঞাপন নির্ভর মুনাফা করার পরিকল্পনা করেন, তাহলে একটা ছবির জীবনচক্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। শত শত নবীন-প্রবীণ নির্মাতাদের মিলনমেলায় বসে তবু একটা স্বপ্ন মনে উকি দিচ্ছিলো বারবার। ভাবছিলাম দেশে এইসব টিভি চ্যানেলসহ বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক সকল লগ্নীকারীরা মিলে যদি এরকম একটা হাট বসাতেন, যেখানে সেলিম ভাই রনিসহ সকল চালাক-বোকা নবীন-প্রবীণ নির্মাতারা যাবেন তাঁদের চিত্রনাট্য নিয়ে আর আবুল খায়ের লিটু, হাবীবুর রহমান খান, ফরিদুর রেজা সাগর, অনন্ত জলিলসহ সকল লগ্নি-ইচ্ছুকেরা যাবেন তাঁদের বাৎসরিক একটা ছবির বাজেট নিয়ে, কেমন হতো? মনে হয়, কূটকৌশল কম জানা অনেক মেধাবী নির্মাতা বেড়িয়ে আসতেন, অন্ধকারে বন্ধ-দ্বারের বাণিজ্য বন্ধ হতো, মিডিয়া-প্রীতির প্রার্দুভাব কমতো আর বছর শেষে ভালো কিছু ছবি তৈরি হতো।